বিনোদনে পাশে থাকুক আপনার পরিবার

জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আমরা সবাই ব্যস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যে, চাকরিতে বা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য সবাই দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছি সময়ের রথে চড়ে। ছুটতে ছুটতে, চলতে-চলতে অনেকেই ভুলে যাই আমাদের চারপাশ এবং পরিবারকে। অনেকে হয়ত চাইলেও পরিবারকেও ঠিকভাবে সময় দিতে পারেন না। কিন্তু যেহেতু আমরা সবাই এখন বাসায় তাই পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য এটি খুব ভালো একটি সময়। পরিবারের সাথে বিভিন্ন ভাবে সময় কাটানো যায়। আপনি চাইলে বিভিন্ন ইনডোর গেমস খেলে বা মুভি দেখার মাধ্যমে পরিবারের সাথে খুব ভালো সময় কাটাতে পারেন।

আর প্রিয় মানুষের সাথে সময় কাটাতে মুভির তুলনা নেই। আজ আপনাদের জন্যে থাকছে কিছু বাংলা মুভির তালিকা যা দেখে প্রিয়জনের সাথে কিছু ভালো সময় উপভোগ করতে পারেন।

১। টেলিভিশন

টেলিভিশন ২০১২ সালে নির্মিত বাংলাদেশের সমাজভিত্তিক একটি মুভি। অভিনয়ে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, তিশা। গল্পটার বিবরণে থাকে বাংলাদেশের নোয়াখালি অঞ্চলের কোন এক গ্রামে এক বয়োজ্যেষ্ঠ চেয়ারম্যান নিজের ধর্ম ও ঈমান বাঁচাতে টেলিভিশন নামক শয়তানের বাক্সকে গ্রামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এছাড়াও ক্যামেরা ব্যবহার ও ছবি তোলাকেও তিনি পাপ জেনে এইসব থেকে নিজে ও গ্রামবাসীকে দূরে রাখেন। সারা গ্রামে একমাত্র তার নিজের কাছে একটি মোবাইল ফোন রাখেন ব্যবসায়িক কাজে যোগাযোগের জন্য। মুভিতে এক করুণ প্রেমের কাহিনীও দেওয়া হয়েছে। ত্রিভুজ প্রেমের শেষে এক থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারও পাওয়া যায়।

২। অজ্ঞাতনামা

২০১৬ সালে নির্মিত হৃদয়স্পর্শী ছবি অজ্ঞাতনামা । অজ্ঞাতনামা শব্দের অর্থ হচ্ছে যার পরিচয় অজানা বা পরিচয়হীন। দালালদের নানা প্রলোভনে ফেঁসে সহজ সরল বাঙ্গালী তরুন বা যুবকটি এক বুক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি যদিও বা দিতে পারে; কিন্তু সেখানে তাকে হারাতে হয় তার সর্বস্ব। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে পরভুমিতে না পায় সে ঠাঁই, না পায় সামান্য মানবিক অধিকার। অধিকন্তু নিজের নাম, পরিচয়টাও কখনো গোপন করতে হয়। পরভূমিতে, পরের নাম-পরিচয়ের আড়ালে লুকাতে গিয়ে এক একজন হয়ে উঠে অজ্ঞাতনামা।  এই সুন্দর ছবি টি তে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুজ্জামান সেলিম, নিপুন, শতাব্দী ওয়াদুদ এবং মোশাররফ করিম।

 

৩। আয়নাবাজি

আয়নাবাজি ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী অপরাধধর্মী থ্রিলার চলচ্চিত্র। এখানে দেখানো হয়েছে একজন পেশাদার অভিনেতা কিভাবে একই সাথে কয়েকটি চরিত্রে বিচরন করে। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র আয়না যে টাকার বিনিময়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের হয়ে জেল খাটে এবং আর স্থানীয় হলিউড স্টুডিওর পরিচালক গাউসুল তাকে অর্ডার এনে দেয়। গল্প, মেকিং, স্টোরি টেলিং, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, কালার গ্রেডিং সহ কমপ্লিট প্যাকেজ হচ্ছে "আয়নাবাজি"। ছবিটি দেখতে দেখতে পরিবারের সংগে কাটিয়ে নিন খুব ভালো একটি মুহূর্ত।

৪। দেবী

হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘মিসির আলি’ সিরিজের একটি উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে ‘দেবী’। উপন্যাসে রানু নামের বিবাহিত এক তরুণীর দৃষ্টি ও শ্রুতি বিভ্রম রহস্যের সমাধানে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের খণ্ডকালীন শিক্ষক মিসির আলি। ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি আলোচনায় আসার অন্যতম কারণ জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এবং তার সৃষ্ট মধ্যবয়সী রহস্যময় চরিত্র মিসির আলী। লেখক এবং চরিত্র দুটোই জনপ্রিয়। এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস দেবী।

৫। রানওয়ে

বাস্তব একটি কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ছবিটি। ঘটনা ২০০৫-০৬ সালের। মূল চরিত্র রুহুল, যে থাকে এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশে, দাদা-মা-ছোট বোন সহ। বাবা মিডেল ইস্টে গেছে কিন্তু অনেকদিন ধরে কোনো খবর নেই। মাদ্রাসায় ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়া রুহুলের জীবন কাটে হতাশায়। ছোটবোন গার্মেন্টসে কাজ করে আর মা মাইক্রো ক্রেডিট লোন নিয়ে গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার টানলেও রুহুল কোনো কাজ জুটাতে পারে না। যদিও সে মামার সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে টুকটাক কম্পিউটার শিখার চেষ্টা করে। আর এই সাইবার ক্যাফেতেই রুহুলের সাথে দেখা হয় আরিফের, যার কারণে রুহুল হয়ে ওঠে অন্য এক রুহুল। একটি সাধারণ ছেলে কিভাবে ধীরে ধীরে জঙ্গি হয়ে ওঠে সেই গল্পই তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন প্রয়াত প্রথিতযশা পরিচালক তারেক মাসুদ।

৬. মনপুরা

চমৎকার একটি ছবি মনপুরা। সোনাই নামের এক জেলে মনপুরা দ্বীপে একা থাকে। অন্যদিকে নায়িকা পরী অন্য গ্রামের এক জেলের মেয়ে । শোনাই পরীর প্রেমে পরে। মনে রাখার মতো একটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ছবিটি। এই সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি।

৭। মাটির ময়না

বাংলা চলচিত্রের এক অনবদ্য সৃষ্টি "মাটির ময়না" মুভিটি।

যেখানে একই সাথে চিত্রায়িত হয়েছে আবহমান গ্রাম বাংলার অনেক পরিচিত ও লুকায়িত চিত্র।

ফুটে উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষার অবস্থা, ফুটে উঠেছে ভুল চিকিৎসা ও অন্ধ বিশ্বাসের ফল, সেই সাথে আরো দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও এর ভয়বহতা।

 

৮। গেরিলা

সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাস অবলম্বনে গেরিলা সিনেমা নির্মিত। বিলকিস (জয়া আহসান) এই গল্পের মূল চরিত্র। শিক্ষিত-সংস্কৃতিমনা-বলিষ্ঠ চিত্তের অধিকারী বিলকিসের স্বামী, প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হাসান (ফেরদৌস), ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিখোঁজ হন। আপন বোধ আর আর হাসানের সান্নিধ্যে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা মন্ত্রে উজ্জীবিত বিলকিস অসুস্থ শ্বাশুড়ীর দেখাশোনা, নিজের ব্যাংকের চাকরি, নিখোঁজ হাসানের খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি ঢাকার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। তার মতোই আরো অনেক নারী চাকুরী বা নিজ সামাজিক অবস্থানের ছত্রছায়ায় গেরিলা যুদ্ধের নানা সাংগঠনিক যোগাযোগ ও পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে নিয়োজিত থেকে গেরিলা যুদ্ধকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। এ সময় হাসানের দুধভাই তসলিম সর্দার(এটিএম শামসুজ্জামান) আর সে সময়ের কিংবদন্তি সুরকার আলতাফ মাহমুদ (আহমেদ রুবেল) অভিভাবকের মতো স্নেহে-পরামর্শে বিলকিসকে ছায়া দেন। পাকিস্তানী বর্বরতা, বাঙ্গালীর প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার দাবী দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিতে সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি বিলকিস সহযোদ্ধাদের সাথে একটি পত্রিকার কাজেও জড়িয়ে যায়, যার নাম "গেরিলা"।

 

৯। হাজার বছর ধরে

 হাজার বছর ধরে এটি ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার জহির রায়হানের কালজয়ী উপন্যাস হাজার বছর ধরে অবলম্বনে একই শিরোনামে নির্মিত হয় এটি।

নদী বয়ে চলেছে আপন গতিতে। গাছে গাছে ফুল ফোটে। আকাশে পাখি উড়ে- আপন মনে গান গায়। হাজার বছর ধরে যেই জীবনধারা বয়ে চলেছে, তাতে আশা-নিরাশা, প্রেম-ভালবাসা, চাওয়া-পাওয়ার খেলা চললেও তা সহজে চোখে পড়ে না, অন্ধকারে ঢাকা থাকে। কঠিন অচলায়তন সমাজে আর যাই থাকুক, নারীর কোন অধিকার নাই। নারী হাতের পুতুল মাত্র। পুরুষ তাকে যেমন নাচায় তেমন নাচে। নিজের ইচ্ছেতে কাউকে বিয়ে করাটা এমন সমাজে অপরাধ, গুরুতর অপরাধ। অন্ধকার এই সমাজে আনাচে কানাচে বাস করে কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন। পরীর দীঘির পাড়ের একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাহিনী। কখন এই গ্রামের গোড়াপত্তন হয়েছিল কেউ বলতে পারে না।

কালের আবর্তে সময় গড়ায়। প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আসে। শুধু পরিবর্তন আসেনা অন্ধকার, কুসংস্কারাছন্ন গ্রাম বাংলার আচলায়তন সমাজে।

 

১০। মনের মানুষ

মুভিটির কাহিনীর শুরু হয় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই শ্রী জ্যোরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সময়ের বিখ্যাত দার্শনিক কবি লালন ফকিরের আলাপচারিতার মাধ্যমে। জীবন দর্শনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জ্যোরিন্দ্রনাথের কৌতুহল এবং লালনের অবাক করা সব উত্তর!! এবং মুভিটি চলে এর ফাঁকে বিভিন্ন সময়ে লালনের জীবনের অতীত কাহিনীগুলির মাধ্যমে। কীভাবে লালনের সাধারণ জীবন হয়ে ওঠে এক বাউলের জীবন। কীভাবে শিমুলতলায় তিনি গড়ে তোলেন অদ্ভূত এক স্বপ্নের সমাজ। কীভাবে মানুষের প্রতিহিংসার শিকার হতে হয় তাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে মনের মানুষের কাহিনী।

কবে পাবো সেই মনের মানুষের দেখা?? আদৌ কি পাবো?? নাকি থেকে যাবো মনের মানুষের থেকে বহু দূরে?? অসীম শূণ্যতার দৃষ্টিতে লালন তাকায় অথৈ পানির নদীটির দিকে। হঠাৎ ভেসে আসে তার কন্ঠে: “মিলন হবে কত দিনে?? আমার মনে মানুষেরও সনে ... “

এভাবেই সমাপ্তি হয় মনের মানুষ মুভিটির। কিন্তু লালনের ন্যায় সকল দর্শকেরই যেন অপূর্ণ থেকে যায় সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য। কবে পাবো মনের মানুষের দেখা?? এভাবেই সম্পূর্ণ মুভিটিতে দর্শকদের এক জীবন দর্শনের নৌকায় ভাসিয়েছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ।